অর্থনৈতিক অঞ্চল, প্রযুক্তিনির্ভর খাত ও বৈদেশিক বিনিয়োগের নতুন নীতি: প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সরকারের কৌশল
বাংলাদেশের শিল্পায়ন: সংকটের মধ্যেও নতুন বিনিয়োগের দিগন্ত উন্মোচন
- আপডেট সময় : ০৮:৩০:১৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২ অক্টোবর ২০২৫
- / 144
সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বাংলাদেশের শিল্প খাত কিছুটা চাপের মুখে থাকলেও, নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রাখার জন্য এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। যদিও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছিল, তবুও অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইকোনমিক জোন) ও মেগা প্রকল্পগুলো দেশকে দীর্ঘমেয়াদি শিল্পায়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তবে এই গতি ধরে রাখতে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রবাহ বৃদ্ধি করা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
বিনিয়োগের নতুন ক্ষেত্র: ইকো-ফ্রেন্ডলি ও অবকাঠামো
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে শিল্প খাতের অবদান ক্রমশ বাড়ছে; ২০২২-২৩ অর্থবছরে স্থিরমূল্যে জিডিপিতে এই খাতের অবদান দাঁড়িয়েছে ৩৭.৬৫ শতাংশ। এই ধারাকে আরও বেগবান করতে সরকার বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)-এর মাধ্যমে দেশজুড়ে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো প্রতিষ্ঠা করেছে। এই অঞ্চলগুলো দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য ওয়ান-স্টপ সেবা, কর সুবিধা এবং উন্নত অবকাঠামো নিশ্চিত করছে। বিশেষ করে, কক্সবাজারের মাতারবাড়ি বা পটুয়াখালীর পায়রা বন্দরের মতো মেগা প্রকল্পগুলো দক্ষিণাঞ্চলে ভারী শিল্প ও যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটাচ্ছে, যা বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার অন্যতম প্রধান কারণ।
পাশাপাশি, দেশের অর্থনৈতিক বিকাশে একটি নতুন প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে—ইকো-ফ্রেন্ডলি স্টার্টআপ এবং টেকসই শিল্পায়নের দিকে মনোযোগ। বৈশ্বিক চাহিদা পূরণে এবং পরিবেশ সংরক্ষণে এই ধরনের পরিবেশবান্ধব উদ্যোগগুলো আগামী দিনের বিনিয়োগের প্রধান ক্ষেত্র হতে পারে।

এফডিআই-এর প্রবণতা ও চ্যালেঞ্জ
বিনিয়োগের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও, এফডিআই (FDI) প্রবাহে উত্থান-পতন দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে এফডিআই আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১৩.৭ শতাংশ কম এসেছিল। যদিও ২০২৪ সালের প্রথম তিন মাসে নিট এফডিআই বৃদ্ধি পেয়েছিল, তবে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং
নীতিগত ধারাবাহিকতার অভাবের কারণে দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রাখতে নীতিমালার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা এবং শুল্ক-কর সংক্রান্ত নীতিতে ঘন ঘন পরিবর্তন পরিহার করা জরুরি।
তবে আশার কথা হলো, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) নীতিগত সংস্কারের মাধ্যমে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির কাজ করছে এবং নতুন শিল্প প্রকল্প নিবন্ধনের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য যৌথ উদ্যোগের ক্ষেত্রেও আগ্রহ সৃষ্টিতে কাজ করছে।
ঘুরে দাঁড়ানোর কৌশল: আস্থা ও স্থানীয় বিনিয়োগ
শিল্পায়নের এই নতুন দিগন্তে সফল হতে হলে কেবল বিদেশি বিনিয়োগের দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবে না। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, দেশের সার্বিক বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নয়নে স্থানীয় বিনিয়োগকে জোরদার করা এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় উদ্যোক্তাদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে এবং তাদের জন্য ব্যবসা সহজ করার পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকার কর্তৃক দেশীয় রফতানিকারকদের জন্য বিদেশে বিনিয়োগের পথ খুলে দেওয়া সংক্রান্ত নতুন নীতিমালা একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ, যা দেশের শিল্পকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি করবে।
মূলত, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক অঞ্চলের মতো দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপগুলো বাংলাদেশের শিল্পায়নের গতিকে ধরে রাখবে। তবে এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, নীতিমালার ধারাবাহিকতা এবং স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি আস্থাশীল পরিবেশ নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য সংযমী বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) মাধ্যমে সরকার চলমান বড় প্রকল্পগুলোয় নজর দিচ্ছে, যা সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারকে নির্দেশ করে। এই সমন্বিত উদ্যোগগুলোই ভবিষ্যতে বাংলাদেশের শিল্পায়নকে আরও মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাবে।

















