দেশি উন্নতির গল্প রয়েছে, কিন্তু দুর্বিষহ ব্যক্তিগত খরচ, কর্মী ঘাটতি আর জলবায়ু-চাপ স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ক্রমেই দুর্বল করে তুলছে — সময়োপযোগী সংস্কারের দাবি।
স্বাস্থ্য খাতের বাস্তব চিত্র ও করণীয়: চিকিৎসা নিরাপত্তা কি একবারে অর্জন সম্ভব?
- আপডেট সময় : ০৮:৩০:০৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫
- / 190
সম্পাদকীয় — স্বাস্থ্য খাতের বাস্তব চিত্র ও করণীয়
বাংলাদেশ গত কয়েক দশকে স্বাস্থ্য সূচকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখালেও—জন্মনিয়ন্ত্রণ, উপশম প্রয়াস ও অনাকাঙ্ক্ষিত শিশুমৃত্যু হ্রাস—আজকের স্বাস্থ্যখাত বহু জটিল চ্যালেঞ্জে জর্জরিত। সরকারি স্বাস্থ্যখাতে ব্যয়ের শতাংশ এখনও স্বল্প (মোট যোগফলে GDP-র নিম্নহার), যার ফলে জনগণের বহুগুণ ব্যক্তিগত খরচ বা OOP (Out-of-Pocket) বাড়ছে। WHO-র ডেটা ও সাম্প্রতিক বিশ্লেষণের আলোকে দেখা যায়, স্বাস্থ্যব্যয়ের উপর বাড়তি ব্যক্তি ব্যয় দরিদ্র ঘরানার স্বাস্থ্যসুরক্ষাকে ভঙ্গ করছে।
চলমান বাস্তবতা তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মাত্রায় প্রতীয়মান — অর্থনীতি, মানবসম্পদ ও জলবায়ু-ভিত্তিক ঝুঁকি। প্রথমত, সরকারি স্বাস্থ্যব্যয় GDP-এর খুব কম অংশ হওয়ায় (নির্দিষ্ট হার WHO ডেটাতে স্পষ্ট), প্রাথমিক ও নন-কমিউনিকেবল রোগ (যেমন হৃদরোগ, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস) মোকাবিলায় সুদৃঢ় প্রাতিষ্ঠানিক যোগান দেওয়া কঠিন।
দ্বিতীয়ত, যথেষ্ট প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী—ডাক্তার, নার্স ও আল্ট্রা-ল্যাব প্রযুক্তিবিদ—গ্রামীণ ও শহর উভয় অঞ্চলে অসমভাবে ছড়িয়ে আছে। ফলত—নির্দিষ্ট রোগবোধ বা অতিসংক্রমণকালীন (যেমন ডেঙ্গু) সেবা কেন্দ্রীভূত হাসপাতালে চাপ সৃষ্টি করে এবং প্রাথমিক পর্যায়ে সঠিক চিকিৎসার অভাব রোগীর অবস্থা বাড়িয়ে দেয়। ২০২৪-২০২৫ সময়ে উল্লেখযোগ্য ডেঙ্গু সংক্রমণ ও মৃত্যু আমাদের অসংগঠিত প্রস্তুতির এক নজির।

তৃতীয়ত, জলবায়ুর পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ—বন্যা, অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত—স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়েছে; খাদ্য নিরাপত্তা, পানীয়জলের গুণগত ক্ষয় ও মানসিক স্বাস্থ্য সব ক্ষেত্রেই প্রভাব পড়ছে। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক মূল্যায়ন নির্দেশ করে, তাপমাত্রা ও পরিবেশগত চাপ বৃদ্ধির কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব বাড়বে—এটি কেবল স্বাস্থ্য খাত নয়, বৃহত্তর উন্নয়নকেই ঝুঁকিতে ফেলে।
এই বাস্তব চিত্র থেকে করণীয় কি? সংক্ষেপে চারটি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত পরিকল্পনা অবিলম্বে গ্রহণ করা দরকার:
১) স্বাস্থ্য ব্যয়ের পুনর্গঠন ও আর্থিক সুরক্ষা
সরকারকে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় বাড়াতে হবে এবং জনগণের OOP নির্ভরতা কমাতে সামাজিক স্বাস্থ্য বিমা/বহুমাত্রিক সাবসিডি পদ্ধতি জরুরি। স্বাস্থ্যসেবা পর্যাপ্তভাবে সাশ্রয়ী নাও হলে দরিদ্র পরিবারকে বিনা চিকিৎসায় পৌঁছাতে পারবে না — দীর্ঘমেয়াদে এটি মানবসম্পদ উৎপাদনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
২) প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার শক্তায়ন
গ্রামীন ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে হবে — প্রশিক্ষিত কর্মী, দ্রুত ল্যাব সেবা, টেলিমেডিসিন সুবিধা ও মৌলিক ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে এগুলো সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি হাসপাতালে চাপও কমাবে। বিশ্বব্যাংকের সুপারিশগুলো এখানে প্রাসঙ্গিক।
৩) মানুষ-ভিত্তিক কৌশল — কর্মী উন্নয়ন ও বৈষম্য হ্রাস
নার্সিং শিক্ষায় বিনিয়োগ, গ্রামীন ডাক্তারদের ইনসেনটিভ, মেন্টাল-হেলথ ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রবেশাধিকার বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্যকর্মীর ন্যায্য বেতন ও কর্মপরিবেশ উন্নত করলে জনসংখ্যার চাহিদা মেটানো সহজ হবে।
৪) দ্রুত প্রতিরোধ ও পরিবেশগত প্রস্তুতি
ডেঙ্গু, বন্যা ও জলবায়ু-প্রভাবিত রোগ নিয়ন্ত্রণে সার্বিক অবকাঠামো এবং ভেক্টর-নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা শক্ত করা দরকার। পাশাপাশি জরুরি রোগতত্ত্ব, জরুরি সেবা ও সাপ্লাই-চেইনকে দুর্যোগ-সহনশীল করে তোলা জরুরি। সাম্প্রতিক ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবই আমাদের প্রস্তুতির ঘাটতি প্রকাশ করে।
শেষ কথা — স্বাস্থ্য খাত সংস্কার একটি কেবল অর্থববস্থাগত কাজ নয়, এটি সামাজিক ন্যায়বিচারের বিষয়। রাজনৈতিক সংকল্প, সুশাসন, স্বচ্ছতা ও নাগরিক অংশগ্রহণ মিলে যদি আমরা স্বাস্থ্যকেই জাতির অগ্রাধিকার হিসেবে গ্রহণ করি, তা হলে—সবার জন্য মানসম্মত ও সাশ্রয়ী স্বাস্থ্যসেবা সম্ভব। নীতি নির্ধারকরা এখনই সিদ্ধান্ত নিন: কেবল সংখ্যা বাড়ানো নয়, মান বাড়াতে হবে; কেবল হাসপাতাল ভবন নয়, মানুষের জীবনমান নিশ্চিত করতে হবে।

















