বাংলাদেশ ১২:০৩ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
Insaf World Banner

জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস: ইতিহাসের এক রক্তক্ষয়ী বাঁক

ইমরান হোসেন, সম্পাদক, ইনসাফ বিশ্ব
  • আপডেট সময় : ১০:২০:৫১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৭ নভেম্বর ২০২৫
  • / 71

ছবি : সম্পাদকীয়

Insaf World Banner
"ইনসাফ বিশ্ব" পত্রিকার নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি
সংবাদটি শেয়ার করুন :

নভেম্বরের ৭ তারিখ—বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে এক গভীর, বহুমাত্রিক ও রক্তক্ষয়ী বাঁকবদলের দিন। ১৯৭৫ সালের এই দিনে সংঘটিত ‘সিপাহী-জনতার বিপ্লব’ কেবল ক্ষমতার পালাবদল ঘটায়নি, বরং তা সদ্য স্বাধীন দেশটির আদর্শিক ভিত্তি, সামরিক শৃঙ্খলা এবং জাতীয় চেতনার গতিপথকে মৌলিকভাবে পরিবর্তন করেছিল। স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র চার বছরের মাথায় জাতি যে গভীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক অস্থিরতায় ডুবে গিয়েছিল, ৭ নভেম্বর ছিল সেই অনিশ্চয়তার অবসান ঘটিয়ে জাতীয় সংহতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার এক ঐতিহাসিক প্রচেষ্টা।

Insaf World Banner 1

অস্থিরতার প্রেক্ষাপট: আগস্ট থেকে নভেম্বর

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর দেশ এক গভীর রাজনৈতিক শূন্যতায় পতিত হয়। এরপর ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। এই অভ্যুত্থানের ফলে তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান নিজ বাসভবনে গৃহবন্দী হন এবং খালেদ মোশাররফ নিজেকে ক্ষমতার কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। এই ঘটনার মধ্যেই ৩ নভেম্বর দিবাগত রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হয়। সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ে, এবং দেশে বিদেশি হস্তক্ষেপের গুজব ও গভীর ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা ছড়াতে থাকে।

Insaf World Banner 2

সিপাহী-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত জাগরণ

দেশের এই চরম অস্থিতিশীল মুহূর্তে, ৪ দিন গৃহবন্দী থাকার পর, ৭ নভেম্বরের ভোরে ঘটে যায় এক ঐতিহাসিক পাল্টা-বিপ্লব। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের মুক্তির দাবিতে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-এর গণবাহিনীর সহায়তায় সাধারণ সিপাহীরা বিদ্রোহ করে এবং ঢাকার রাস্তায় নেমে আসে। এই অভ্যুত্থান নিছক সামরিক ছিল না; দেশপ্রেমিক সিপাহীদের সাথে সাধারণ জনতা ঐক্যবদ্ধভাবে রাস্তায় নেমে আসে, যার ফলে এটি ‘সিপাহী-জনতার বিপ্লব’ নামে পরিচিতি লাভ করে। জনতার এই স্বতঃস্ফূর্ত জাগরণ ছিল মূলত বাকশালী দুঃশাসন, রাজনৈতিক শূন্যতা এবং সামরিক ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার এক সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষা

৭ নভেম্বরের ‘হিরো’: জিয়াউর রহমান

এই দিনের প্রধান চরিত্র বা ‘হিরো’ নিঃসন্দেহে ছিলেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান (বীর উত্তম)। সিপাহী ও জনতা যখন স্লোগান দিতে দিতে তাঁকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসে, তখন তিনি জনগণের মাঝে এক অসামান্য আস্থা ও জনপ্রিয়তা নিয়ে আবির্ভূত হন।

সংকটমোচকের ভূমিকা: মুক্তির পর জিয়াউর রহমান দ্রুত সামরিক বাহিনীর শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন। তার নেতৃত্বে দেশ সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরীণ বিভাজন ও বিশৃঙ্খলা থেকে বেরিয়ে এসে একটি নির্দিষ্ট কাঠামোর দিকে এগোতে শুরু করে।

গণতন্ত্রের পথ: জিয়াউর রহমান পরবর্তীতে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেশের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। সামরিক শাসন থেকে দ্রুত গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্যে তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন এবং জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রনায়কের আসনে আসীন হন।

জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ: জিয়াউর রহমানের হাত ধরেই ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ দর্শনটি দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়, যা দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তিকে একটি অভিন্ন জাতীয় পরিচয়ের ছাতার নিচে নিয়ে আসে।

তাৎপর্য ও আজকের প্রাসঙ্গিকতা

৭ নভেম্বর ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার এক কঠিন পরীক্ষা। এটি কেবল একজন নেতাকে মুক্তি দেয়নি, বরং দেশের রাজনৈতিক গতিপথকে একদলীয় শাসন থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের দিকে ফিরিয়ে এনেছিল। দিনটিকে ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ হিসেবে পালনের মাধ্যমে বিএনপি এবং তার সমর্থকরা মনে করেন যে, এই দিনেই জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল এবং স্বাধীনতা রক্ষার প্রকৃত অঙ্গীকার পুনরায় দৃঢ় হয়েছিল।

এই দিনটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন। সামরিক বাহিনী ও সাধারণ জনগণের সম্মিলিত প্রয়াসে সেদিন যে সংহতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা, জনগণের মৌলিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের জন্য ছিল এক ঐতিহাসিক ‘সোপান’। আজকের দিনেও দেশের সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র ও জাতীয় সংহতি রক্ষায় ৭ নভেম্বরের চেতনা অপরিহার্য।

সংবাদটি শেয়ার করুন :
Insaf World Banner 1
Insaf World Banner 2

জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস: ইতিহাসের এক রক্তক্ষয়ী বাঁক

আপডেট সময় : ১০:২০:৫১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৭ নভেম্বর ২০২৫
সংবাদটি শেয়ার করুন :

নভেম্বরের ৭ তারিখ—বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে এক গভীর, বহুমাত্রিক ও রক্তক্ষয়ী বাঁকবদলের দিন। ১৯৭৫ সালের এই দিনে সংঘটিত ‘সিপাহী-জনতার বিপ্লব’ কেবল ক্ষমতার পালাবদল ঘটায়নি, বরং তা সদ্য স্বাধীন দেশটির আদর্শিক ভিত্তি, সামরিক শৃঙ্খলা এবং জাতীয় চেতনার গতিপথকে মৌলিকভাবে পরিবর্তন করেছিল। স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র চার বছরের মাথায় জাতি যে গভীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক অস্থিরতায় ডুবে গিয়েছিল, ৭ নভেম্বর ছিল সেই অনিশ্চয়তার অবসান ঘটিয়ে জাতীয় সংহতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার এক ঐতিহাসিক প্রচেষ্টা।

Insaf World Banner 1

অস্থিরতার প্রেক্ষাপট: আগস্ট থেকে নভেম্বর

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর দেশ এক গভীর রাজনৈতিক শূন্যতায় পতিত হয়। এরপর ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। এই অভ্যুত্থানের ফলে তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান নিজ বাসভবনে গৃহবন্দী হন এবং খালেদ মোশাররফ নিজেকে ক্ষমতার কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। এই ঘটনার মধ্যেই ৩ নভেম্বর দিবাগত রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হয়। সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ে, এবং দেশে বিদেশি হস্তক্ষেপের গুজব ও গভীর ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা ছড়াতে থাকে।

Insaf World Banner 2

সিপাহী-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত জাগরণ

দেশের এই চরম অস্থিতিশীল মুহূর্তে, ৪ দিন গৃহবন্দী থাকার পর, ৭ নভেম্বরের ভোরে ঘটে যায় এক ঐতিহাসিক পাল্টা-বিপ্লব। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের মুক্তির দাবিতে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-এর গণবাহিনীর সহায়তায় সাধারণ সিপাহীরা বিদ্রোহ করে এবং ঢাকার রাস্তায় নেমে আসে। এই অভ্যুত্থান নিছক সামরিক ছিল না; দেশপ্রেমিক সিপাহীদের সাথে সাধারণ জনতা ঐক্যবদ্ধভাবে রাস্তায় নেমে আসে, যার ফলে এটি ‘সিপাহী-জনতার বিপ্লব’ নামে পরিচিতি লাভ করে। জনতার এই স্বতঃস্ফূর্ত জাগরণ ছিল মূলত বাকশালী দুঃশাসন, রাজনৈতিক শূন্যতা এবং সামরিক ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার এক সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষা

৭ নভেম্বরের ‘হিরো’: জিয়াউর রহমান

এই দিনের প্রধান চরিত্র বা ‘হিরো’ নিঃসন্দেহে ছিলেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান (বীর উত্তম)। সিপাহী ও জনতা যখন স্লোগান দিতে দিতে তাঁকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসে, তখন তিনি জনগণের মাঝে এক অসামান্য আস্থা ও জনপ্রিয়তা নিয়ে আবির্ভূত হন।

সংকটমোচকের ভূমিকা: মুক্তির পর জিয়াউর রহমান দ্রুত সামরিক বাহিনীর শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন। তার নেতৃত্বে দেশ সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরীণ বিভাজন ও বিশৃঙ্খলা থেকে বেরিয়ে এসে একটি নির্দিষ্ট কাঠামোর দিকে এগোতে শুরু করে।

গণতন্ত্রের পথ: জিয়াউর রহমান পরবর্তীতে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেশের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। সামরিক শাসন থেকে দ্রুত গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্যে তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন এবং জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রনায়কের আসনে আসীন হন।

জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ: জিয়াউর রহমানের হাত ধরেই ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ দর্শনটি দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়, যা দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তিকে একটি অভিন্ন জাতীয় পরিচয়ের ছাতার নিচে নিয়ে আসে।

তাৎপর্য ও আজকের প্রাসঙ্গিকতা

৭ নভেম্বর ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার এক কঠিন পরীক্ষা। এটি কেবল একজন নেতাকে মুক্তি দেয়নি, বরং দেশের রাজনৈতিক গতিপথকে একদলীয় শাসন থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের দিকে ফিরিয়ে এনেছিল। দিনটিকে ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ হিসেবে পালনের মাধ্যমে বিএনপি এবং তার সমর্থকরা মনে করেন যে, এই দিনেই জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল এবং স্বাধীনতা রক্ষার প্রকৃত অঙ্গীকার পুনরায় দৃঢ় হয়েছিল।

এই দিনটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন। সামরিক বাহিনী ও সাধারণ জনগণের সম্মিলিত প্রয়াসে সেদিন যে সংহতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা, জনগণের মৌলিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের জন্য ছিল এক ঐতিহাসিক ‘সোপান’। আজকের দিনেও দেশের সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র ও জাতীয় সংহতি রক্ষায় ৭ নভেম্বরের চেতনা অপরিহার্য।

সংবাদটি শেয়ার করুন :