দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
- আপডেট সময় : ১২:৩৩:৩৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর ২০২৪
- / 359
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ দীর্ঘদিন ধরে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে আর্থিক চাপে রয়েছে। দেশের অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র এবং তাদের প্রধান জীবিকা হলো কৃষিকাজ ও কম বেতনের বেসরকারি চাকরি। সামান্য কিছু মানুষ সরকারি চাকরি বা ধনী শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হলেও, সাধারণ মানুষের জীবনযাপন ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠেছে। এই অবস্থার জন্য বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বাজার সিন্ডিকেটকে দায়ী করা হয়েছে। বিশেষ করে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার আমলে দলের লোকদের দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
৫ই আগস্ট স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা পদত্যাগ করার পর ডক্টর মোহাম্মদ ইউনুসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করা হয়। সাধারণ মানুষের মধ্যে এই পরিবর্তনের ফলে আশার আলো জাগলেও, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যায়নি। অথচ দেশের জনগণের কাছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের থেকে অনেক প্রত্যাশা ছিল, বিশেষ করে দ্রব্যমূল্যের ব্যাপারে।
ডক্টর ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখনও সময় পাচ্ছে না সঠিক পরিকল্পনা কার্যকর করতে, তবে জনগণের কাছে এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তাদের আর্থিক নিরাপত্তা। দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান চাপ একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি। তাই এই সময়ে সরকারকে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে কয়েকটি মূল কারণ রয়েছে। প্রথমত, স্বৈরশাসনের সময়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বাজার সিন্ডিকেট গঠন করে মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছিল। সিন্ডিকেটগুলো স্বাভাবিক বাজার ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে তুলে এবং মূল্য বৃদ্ধি করে নিজেদের মুনাফা বৃদ্ধি করে। এটি দেশের দরিদ্র জনগণের জীবনযাত্রা আরও দুর্বিষহ করে তুলেছে।
দ্বিতীয়ত, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা এবং আঞ্চলিক রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাবও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রেখেছে। বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য, জ্বালানি এবং অন্যান্য পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধি দেশীয় বাজারকেও প্রভাবিত করেছে। এই সমস্ত কারণগুলি মিলে বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার খরচ ক্রমশ বেড়ে চলেছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা। সরকারের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও পরিকল্পনা না থাকলে, এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। বর্তমান সরকারকে প্রথমেই বাজার সিন্ডিকেটগুলোর ওপর কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে, কারণ তারা সাধারণ মানুষের জন্য ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। সিন্ডিকেটের প্রভাব বন্ধ করে মুক্ত বাজার প্রতিষ্ঠা করতে পারলে মূল্য পরিস্থিতি উন্নতি লাভ করতে পারে।
তবে শুধুমাত্র সিন্ডিকেট ভাঙাই যথেষ্ট নয়। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল করতে হলে সরকারের উচিত কৃষি খাতের উন্নয়ন করা, কারণ দেশের অধিকাংশ মানুষ কৃষির উপর নির্ভরশীল। কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধি, খাদ্য শৃঙ্খল উন্নয়ন এবং সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি না করলে মূল্য নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব।
১. সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ: সরকারকে বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বাজারের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ওপর নজরদারি বাড়াতে হবে এবং তাদের অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি বন্ধ করতে হবে।
২. কৃষি খাতের উন্নয়ন: দেশের কৃষি উৎপাদন বাড়াতে, আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ সরবরাহ করতে হবে। উৎপাদিত পণ্যের সঠিক মূল্য পেতে কৃষকদের সরাসরি বাজারের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে উদ্যোগী হতে হবে।
৩. পর্যাপ্ত জ্বালানি সরবরাহ: বিদ্যুৎ, গ্যাস, ও অন্যান্য জ্বালানির মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির ফলে পরিবহন ও উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়, যা দ্রব্যমূল্যের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।
৪. মানবসম্পদ উন্নয়ন: দেশের কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করতে হলে, মানবসম্পদের দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে হবে। কম বেতনের চাকরিজীবীদের আয় বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ এবং কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
৫. স্বচ্ছ সরকার: সরকারের কাজকর্মে স্বচ্ছতা থাকতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষ সরকারের প্রতি আস্থা রাখতে পারে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করলে অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আসবে এবং মানুষের আর্থিক দুর্দশা কিছুটা কমে আসবে।
ডক্টর ইউনুসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য এই সময়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকারকে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা পূরণে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ছাড়া সরকার সফল হতে পারবে না। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে একটি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা তৈরি করা হলে, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পাবে এবং আস্থার একটি পরিবেশ তৈরি হবে।
তবে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য শুধুমাত্র স্থানীয় পদক্ষেপই যথেষ্ট নয়; সরকারকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি মোকাবেলা করার জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতার দিকেও মনোযোগ দিতে হবে। এছাড়াও, সরকারের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিতে হবে যাতে কৃষি, উৎপাদনশীলতা এবং মানবসম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করা যায়।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী বিষয়। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা পূরণে সরকারকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ, কৃষি খাতের উন্নয়ন, এবং জ্বালানি সরবরাহে স্থিতিশীলতা আনতে পারলে অর্থনীতির ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হবে। ডক্টর ইউনুসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে এই সময়ে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলেও, কার্যকরী পদক্ষেপের মাধ্যমে এটি সমাধান করা সম্ভব।
জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য সরকারের এখনই এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোযোগী হওয়া উচিত। দেশব্যাপী দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও বাজার স্থিতিশীলতা অর্জন করতে হলে, সরকারকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে তা কার্যকর করা দরকার বলে মনে করি

















