বাংলাদেশ ০৩:১৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
Insaf World Banner

জাপানের ভূমিকম্প ব্যবস্থাপনা এবং বাংলাদেশের জন্য শিক্ষা- ড. শাহাবুদ্দীন

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৮:২২:৪৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২১ নভেম্বর ২০২৫
  • / 36

ছবি: ড. শাহাবুদ্দীন

Insaf World Banner
"ইনসাফ বিশ্ব" পত্রিকার নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি
সংবাদটি শেয়ার করুন :

আজ সকাল ১০:৩৮ মিনিট ২৬ সেকেন্ডে ঢাকা থেকে ৩৩ কিলোমিটার দূরে নরসিংদী জেলার মাধবদীতে ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্প সংগঠিত হয়, যার উৎপত্তিস্থল ছিল ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০ কিলোমিটার নিচে।

Insaf World Banner 1

২৬ সেকেন্ড স্থায়িত্বের এই ভূমিকম্পে সর্বশেষ খবর পর্যন্ত অন্তত ৫ জন নিহত হয়েছে, আহতের সংখ্যা শতাধিক।

শক্তিশালী এই ভূমিকম্প অন্তত ১৪ টি জেলায় ব্যাপকভাবে অনুভূত হয়েছে। দেশব্যাপী বিশেষ করে ঢাকা শহরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি পরিলক্ষিত হচ্ছে।

Insaf World Banner 2

ভূমিকম্প প্রবণ ভূতাত্ত্বিক পরিবেশ হওয়া সত্বেও সৌভাগ্যবশত বাংলাদেশ ভূমিকম্পের সংখ্যা তুলনামূলক কম। ১৯৫০ সাল থেকে এ পর্যন্ত মাত্র ১৪ বার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে বাংলাদেশে। যদিও এর আগে অন্তত ডজনখানেক বার বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে এই অঞ্চলে।

বিশেষজ্ঞরা বারবার বাংলাদেশের ভূমিকম্পের মারাত্মক প্রভাব নিয়ে সতর্ক করে আসছে। অপরিকল্পিত নগরায়নের এই দেশে ৬-৭ মাত্রার কোন ভূমিকম্প হলে ক্ষয়ক্ষতি হবে অবর্ণনীয়। যে ভূমিকম্প ব্যবস্থাপনার সামর্থ্য বা পরিকল্পনা কোনটাই আমাদের নেই।

ভূমিকম্প প্রতিরোধ করা না গেলেও সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এর ক্ষয়ক্ষতি বহুলাংশে কমিয়ে ফেলা সম্ভব।

উদাহরণস্বরূপ, জাপান পৃথিবীর সবচেয়ে ভূমিকম্প-প্রবণ দেশ। প্রশান্ত মহাসাগরের “রিং অব ফায়ার” অঞ্চলে অবস্থিত এই দেশটি প্রতিবছর প্রায় ১,৫০০-এর বেশি ভূমিকম্প অনুভব করে যা গড়ে প্রতিদিন ৩টির মতো। এর মধ্যে বেশিরভাগই ক্ষুদ্র মাত্রার হলেও ইতিহাসে বহু বিধ্বংসী ভূমিকম্প এবং সুনামি জাপানকে বিপর্যস্ত করেছে।

তবুও বিস্ময়ের বিষয়, আধুনিক জাপান ভয়াবহ ভূমিকম্পের পরও প্রাণহানি সীমিত রাখতে পারে এবং অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনতে পারে। এই সক্ষমতার পেছনে রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ, কঠোর নীতি, বিজ্ঞানভিত্তিক সিদ্ধান্ত এবং জনসচেতনতা।

বাংলাদেশের সিলেট-মেঘালয় ফল্ট, ভুটান-আসাম ফল্টসহ একাধিক সক্রিয় ফল্ট লাইনের কারণে বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাস্তব।

জাপানের মডেল থেকে বাংলাদেশের শেখার অনেক কিছুই আছে।জাপানের ভূমিকম্প ব্যবস্থাপনার মূল স্তম্ভসমূহ-

১. আধুনিক ভূমিকম্প পূর্বাভাস ও আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা

জাপান মেটেরিওলজিক্যাল এজেন্সি (JMA) বিশ্বের অন্যতম আধুনিক সিসমিক নেটওয়ার্ক পরিচালনা করে। ভূমিকম্পের তরঙ্গ অনুভূত হওয়ার কয়েক সেকেন্ড আগেই সতর্কবার্তা পাঠাতে পারে। এর ফলে উচ্চগতির ট্রেন থেমে যায়, গ্যাস লাইন স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়, স্কুল, হাসপাতাল ও প্রতিষ্ঠান দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারে।

কয়েক সেকেন্ডের সতর্কতাও হাজারো জীবন বাঁচাতে পারে, এটাই জাপানের সবথেকে বড় শক্তি।

২. বিশ্বের কঠোরতম ভূমিকম্প-রেসিস্ট্যান্ট বিল্ডিং কোড

জাপানি স্থাপত্যের মূল নীতি হলো: ভূমিকম্প রোধ করা যায় না, কিন্তু এর ক্ষতি কমানো যায়। তাই ভবনে বেস-আইসোলেশন, ড্যাম্পিং সিস্টেম, নমনীয় কাঠামো এবং গভীর ভিত্তি (deep foundation) ব্যবহার বাধ্যতামূলক।

এ ছাড়া পুরোনো ভবনগুলো নিয়মিত রেট্রোফিটিং করা হয় যা প্রাণহানির ঝুঁকি নাটকীয়ভাবে কমাতে সহায়তা করে।

৩. জাতীয় পর্যায়ে জনসচেতনতা ও প্রশিক্ষণ

প্রতি বছর ১ সেপ্টেম্বর “Disaster Prevention Day” পালিত হয়। দেশজুড়ে কোটি মানুষ একযোগে ভূমিকম্প-মহড়াতে অংশ নেয়। শিশু থেকে প্রবীণ—সবাই জানে ভূমিকম্পের সময় করতে হবে।
স্কুলের পাঠ্যবই, টেলিভিশন, ট্রেনিং সেন্টার সব জায়গায় এই দক্ষতার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

৪. ভূমি-ব্যবস্থা পরিকল্পনা ও ঝুঁকির মানচিত্র (Hazard Map)

জাপান প্রতিটি শহর ও জেলার জন্য বিস্তারিত ভূমিকম্প ও সুনামি ঝুঁকির মানচিত্র তৈরি করে। কোথায় কী ধরনের ভবন হবে, কোন এলাকায় হাসপাতাল বা স্কুল নির্মাণ করা যাবে আর কোথায় যাবে না সবই বৈজ্ঞানিকভাবে নির্ধারিত।

৫. দ্রুত উদ্ধার, পুনর্বাসন ও বীমা ব্যবস্থা

জাপানে ভূমিকম্প হওয়ার মিনিটের মধ্যে দমকল বাহিনী, পুলিশ, স্বেচ্ছাসেবী দল, ড্রোন ও রোবট টিম
কাজে নেমে যায়। এছাড়া বীমা ব্যবস্থা বড় ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবিলায় জনগণকে সুরক্ষা দেয়।

বাংলাদেশের জন্য শিক্ষা:

বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্প কম হলেও, রাজধানী ঢাকা বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ শহর—অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ, দুর্বল ভবন, সরু রাস্তা এবং শৃঙ্খলাহীন অবকাঠামো আমাদের বিপদের মুখে ফেলেছে। জাপানের মডেল থেকে বাংলাদেশ নিম্নলিখিত পদক্ষেপ নিতে পারে:

১. আধুনিক ভূমিকম্প আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা স্থাপন:

সিলেট, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে ডেনসিটি সিসমিক সেন্সর নেটওয়ার্ক স্থাপন। ভূমিকম্পের P-wave সনাক্ত করে মোবাইল সিস্টেম/টিভি/সাইরেনের মাধ্যমে কয়েক সেকেন্ড আগেই সতর্কবার্তা পাঠানো। রেলওয়ে, গ্যাস লাইন, বড় শিল্প কারখানায় স্বয়ংক্রিয় শাটডাউন ব্যবস্থা। এতে বড় বিপর্যয়ের সময় প্রাণহানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে।

২. বাংলাদেশে বিল্ডিং কোড কঠোরভাবে প্রয়োগ

বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড (BNBC) আছে, কিন্তু এর বাস্তবায়ন দুর্বল। ফলে সকল নতুন ভবনে বাধ্যতামূলক সিসমিক ডিজাইন প্রয়োগ করতে হবে। পুরোনো ভবনের রেট্রোফিটিং কর্মসূচি নিতে হবে। হাসপাতাল, স্কুল, সরকারি ভবন—সবাইকে ভূমিকম্প-রেসিস্ট্যান্ট করতে হবে। ভবন অনুমোদনে দুর্নীতি রোধে বিশেষ জোনাল অথরিটি গঠন করতে হবে।

জাপানি অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, শক্তিশালী ভবন অন্তত অর্ধেক ঝুঁকি হ্রাস করে দেয়।

৩. জাতীয় পর্যায়ে জনসচেতনতা প্রোগ্রাম

বাংলাদেশে অধিকাংশ মানুষ জানেন না ভূমিকম্পের সময় কী করতে হয়। তাই স্কুল-কলেজে ভূমিকম্প ব্যবস্থাপনার প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। টিভি, অনলাইন, মসজিদ-মন্দিরে নিয়মিত প্রচার প্রচারণা এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতি বছর জাতীয় ভূমিকম্প মহড়া দিবস আয়োজন করা যেতে পারে। সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারলে অনেক প্রাণহানি এবং সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব।

৪. ঝুঁকির মানচিত্র (Hazard Map) তৈরি ও নগর পরিকল্পনা পুনর্গঠন:

ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম সহ ঘনবসতিপূর্ণ মহানগরীতে বিল্ডিং-বাই-বিল্ডিং ঝুঁকি মানচিত্র তৈরি করা। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় উচ্চ ভবন নির্মাণ নিষিদ্ধ করা। বড় স্কুল, হাসপাতাল ও স্টেডিয়াম নিরাপদ জোনে স্থানান্তর করা।

ভূমিকম্প হলো বৈজ্ঞানিক বিষয়, তাই নগর পরিকল্পনাও বিজ্ঞানের উপর ভিত্তি করে পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন জরুরি।

৫. উদ্ধার, পুনর্বাসন ও বীমা ব্যবস্থা উন্নতকরণ:
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সকে আধুনিক সরঞ্জাম দেওয়া। উদ্ধার কাজে ড্রোন, সেন্সর, থার্মাল ক্যামেরা, রোবট ব্যবহার নিশ্চিত করা। দুর্যোগ বীমা ব্যবস্থা চালু করা যাতে সাধারণ মানুষ ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারে। সর্বোপরি, জাপানের মতো দ্রুত উদ্ধার ও পুনর্বাসন জান মালের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে পারে উল্লেখযোগ্যভাবে।

সংবাদটি শেয়ার করুন :
Insaf World Banner 1
Insaf World Banner 2

জাপানের ভূমিকম্প ব্যবস্থাপনা এবং বাংলাদেশের জন্য শিক্ষা- ড. শাহাবুদ্দীন

আপডেট সময় : ০৮:২২:৪৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২১ নভেম্বর ২০২৫
সংবাদটি শেয়ার করুন :

আজ সকাল ১০:৩৮ মিনিট ২৬ সেকেন্ডে ঢাকা থেকে ৩৩ কিলোমিটার দূরে নরসিংদী জেলার মাধবদীতে ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্প সংগঠিত হয়, যার উৎপত্তিস্থল ছিল ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০ কিলোমিটার নিচে।

Insaf World Banner 1

২৬ সেকেন্ড স্থায়িত্বের এই ভূমিকম্পে সর্বশেষ খবর পর্যন্ত অন্তত ৫ জন নিহত হয়েছে, আহতের সংখ্যা শতাধিক।

শক্তিশালী এই ভূমিকম্প অন্তত ১৪ টি জেলায় ব্যাপকভাবে অনুভূত হয়েছে। দেশব্যাপী বিশেষ করে ঢাকা শহরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি পরিলক্ষিত হচ্ছে।

Insaf World Banner 2

ভূমিকম্প প্রবণ ভূতাত্ত্বিক পরিবেশ হওয়া সত্বেও সৌভাগ্যবশত বাংলাদেশ ভূমিকম্পের সংখ্যা তুলনামূলক কম। ১৯৫০ সাল থেকে এ পর্যন্ত মাত্র ১৪ বার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে বাংলাদেশে। যদিও এর আগে অন্তত ডজনখানেক বার বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে এই অঞ্চলে।

বিশেষজ্ঞরা বারবার বাংলাদেশের ভূমিকম্পের মারাত্মক প্রভাব নিয়ে সতর্ক করে আসছে। অপরিকল্পিত নগরায়নের এই দেশে ৬-৭ মাত্রার কোন ভূমিকম্প হলে ক্ষয়ক্ষতি হবে অবর্ণনীয়। যে ভূমিকম্প ব্যবস্থাপনার সামর্থ্য বা পরিকল্পনা কোনটাই আমাদের নেই।

ভূমিকম্প প্রতিরোধ করা না গেলেও সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এর ক্ষয়ক্ষতি বহুলাংশে কমিয়ে ফেলা সম্ভব।

উদাহরণস্বরূপ, জাপান পৃথিবীর সবচেয়ে ভূমিকম্প-প্রবণ দেশ। প্রশান্ত মহাসাগরের “রিং অব ফায়ার” অঞ্চলে অবস্থিত এই দেশটি প্রতিবছর প্রায় ১,৫০০-এর বেশি ভূমিকম্প অনুভব করে যা গড়ে প্রতিদিন ৩টির মতো। এর মধ্যে বেশিরভাগই ক্ষুদ্র মাত্রার হলেও ইতিহাসে বহু বিধ্বংসী ভূমিকম্প এবং সুনামি জাপানকে বিপর্যস্ত করেছে।

তবুও বিস্ময়ের বিষয়, আধুনিক জাপান ভয়াবহ ভূমিকম্পের পরও প্রাণহানি সীমিত রাখতে পারে এবং অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনতে পারে। এই সক্ষমতার পেছনে রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ, কঠোর নীতি, বিজ্ঞানভিত্তিক সিদ্ধান্ত এবং জনসচেতনতা।

বাংলাদেশের সিলেট-মেঘালয় ফল্ট, ভুটান-আসাম ফল্টসহ একাধিক সক্রিয় ফল্ট লাইনের কারণে বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাস্তব।

জাপানের মডেল থেকে বাংলাদেশের শেখার অনেক কিছুই আছে।জাপানের ভূমিকম্প ব্যবস্থাপনার মূল স্তম্ভসমূহ-

১. আধুনিক ভূমিকম্প পূর্বাভাস ও আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা

জাপান মেটেরিওলজিক্যাল এজেন্সি (JMA) বিশ্বের অন্যতম আধুনিক সিসমিক নেটওয়ার্ক পরিচালনা করে। ভূমিকম্পের তরঙ্গ অনুভূত হওয়ার কয়েক সেকেন্ড আগেই সতর্কবার্তা পাঠাতে পারে। এর ফলে উচ্চগতির ট্রেন থেমে যায়, গ্যাস লাইন স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়, স্কুল, হাসপাতাল ও প্রতিষ্ঠান দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারে।

কয়েক সেকেন্ডের সতর্কতাও হাজারো জীবন বাঁচাতে পারে, এটাই জাপানের সবথেকে বড় শক্তি।

২. বিশ্বের কঠোরতম ভূমিকম্প-রেসিস্ট্যান্ট বিল্ডিং কোড

জাপানি স্থাপত্যের মূল নীতি হলো: ভূমিকম্প রোধ করা যায় না, কিন্তু এর ক্ষতি কমানো যায়। তাই ভবনে বেস-আইসোলেশন, ড্যাম্পিং সিস্টেম, নমনীয় কাঠামো এবং গভীর ভিত্তি (deep foundation) ব্যবহার বাধ্যতামূলক।

এ ছাড়া পুরোনো ভবনগুলো নিয়মিত রেট্রোফিটিং করা হয় যা প্রাণহানির ঝুঁকি নাটকীয়ভাবে কমাতে সহায়তা করে।

৩. জাতীয় পর্যায়ে জনসচেতনতা ও প্রশিক্ষণ

প্রতি বছর ১ সেপ্টেম্বর “Disaster Prevention Day” পালিত হয়। দেশজুড়ে কোটি মানুষ একযোগে ভূমিকম্প-মহড়াতে অংশ নেয়। শিশু থেকে প্রবীণ—সবাই জানে ভূমিকম্পের সময় করতে হবে।
স্কুলের পাঠ্যবই, টেলিভিশন, ট্রেনিং সেন্টার সব জায়গায় এই দক্ষতার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

৪. ভূমি-ব্যবস্থা পরিকল্পনা ও ঝুঁকির মানচিত্র (Hazard Map)

জাপান প্রতিটি শহর ও জেলার জন্য বিস্তারিত ভূমিকম্প ও সুনামি ঝুঁকির মানচিত্র তৈরি করে। কোথায় কী ধরনের ভবন হবে, কোন এলাকায় হাসপাতাল বা স্কুল নির্মাণ করা যাবে আর কোথায় যাবে না সবই বৈজ্ঞানিকভাবে নির্ধারিত।

৫. দ্রুত উদ্ধার, পুনর্বাসন ও বীমা ব্যবস্থা

জাপানে ভূমিকম্প হওয়ার মিনিটের মধ্যে দমকল বাহিনী, পুলিশ, স্বেচ্ছাসেবী দল, ড্রোন ও রোবট টিম
কাজে নেমে যায়। এছাড়া বীমা ব্যবস্থা বড় ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবিলায় জনগণকে সুরক্ষা দেয়।

বাংলাদেশের জন্য শিক্ষা:

বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্প কম হলেও, রাজধানী ঢাকা বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ শহর—অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ, দুর্বল ভবন, সরু রাস্তা এবং শৃঙ্খলাহীন অবকাঠামো আমাদের বিপদের মুখে ফেলেছে। জাপানের মডেল থেকে বাংলাদেশ নিম্নলিখিত পদক্ষেপ নিতে পারে:

১. আধুনিক ভূমিকম্প আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা স্থাপন:

সিলেট, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে ডেনসিটি সিসমিক সেন্সর নেটওয়ার্ক স্থাপন। ভূমিকম্পের P-wave সনাক্ত করে মোবাইল সিস্টেম/টিভি/সাইরেনের মাধ্যমে কয়েক সেকেন্ড আগেই সতর্কবার্তা পাঠানো। রেলওয়ে, গ্যাস লাইন, বড় শিল্প কারখানায় স্বয়ংক্রিয় শাটডাউন ব্যবস্থা। এতে বড় বিপর্যয়ের সময় প্রাণহানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে।

২. বাংলাদেশে বিল্ডিং কোড কঠোরভাবে প্রয়োগ

বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড (BNBC) আছে, কিন্তু এর বাস্তবায়ন দুর্বল। ফলে সকল নতুন ভবনে বাধ্যতামূলক সিসমিক ডিজাইন প্রয়োগ করতে হবে। পুরোনো ভবনের রেট্রোফিটিং কর্মসূচি নিতে হবে। হাসপাতাল, স্কুল, সরকারি ভবন—সবাইকে ভূমিকম্প-রেসিস্ট্যান্ট করতে হবে। ভবন অনুমোদনে দুর্নীতি রোধে বিশেষ জোনাল অথরিটি গঠন করতে হবে।

জাপানি অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, শক্তিশালী ভবন অন্তত অর্ধেক ঝুঁকি হ্রাস করে দেয়।

৩. জাতীয় পর্যায়ে জনসচেতনতা প্রোগ্রাম

বাংলাদেশে অধিকাংশ মানুষ জানেন না ভূমিকম্পের সময় কী করতে হয়। তাই স্কুল-কলেজে ভূমিকম্প ব্যবস্থাপনার প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। টিভি, অনলাইন, মসজিদ-মন্দিরে নিয়মিত প্রচার প্রচারণা এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতি বছর জাতীয় ভূমিকম্প মহড়া দিবস আয়োজন করা যেতে পারে। সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারলে অনেক প্রাণহানি এবং সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব।

৪. ঝুঁকির মানচিত্র (Hazard Map) তৈরি ও নগর পরিকল্পনা পুনর্গঠন:

ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম সহ ঘনবসতিপূর্ণ মহানগরীতে বিল্ডিং-বাই-বিল্ডিং ঝুঁকি মানচিত্র তৈরি করা। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় উচ্চ ভবন নির্মাণ নিষিদ্ধ করা। বড় স্কুল, হাসপাতাল ও স্টেডিয়াম নিরাপদ জোনে স্থানান্তর করা।

ভূমিকম্প হলো বৈজ্ঞানিক বিষয়, তাই নগর পরিকল্পনাও বিজ্ঞানের উপর ভিত্তি করে পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন জরুরি।

৫. উদ্ধার, পুনর্বাসন ও বীমা ব্যবস্থা উন্নতকরণ:
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সকে আধুনিক সরঞ্জাম দেওয়া। উদ্ধার কাজে ড্রোন, সেন্সর, থার্মাল ক্যামেরা, রোবট ব্যবহার নিশ্চিত করা। দুর্যোগ বীমা ব্যবস্থা চালু করা যাতে সাধারণ মানুষ ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারে। সর্বোপরি, জাপানের মতো দ্রুত উদ্ধার ও পুনর্বাসন জান মালের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে পারে উল্লেখযোগ্যভাবে।

সংবাদটি শেয়ার করুন :