সোপান: এক দেশপ্রেমিকের নীরব উপাখ্যান : পর্ব ০৮
- আপডেট সময় : ০৫:৪৭:১৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৫
- / 28
(পর্ব ০৮ : দেশের জন্য বন্ধুত্বের জাল এবং পরামর্শকের জন্ম)
বিশ্ববিদ্যালয়ে হৃদয়ের উপস্থিতি কেবল একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং তার নিঃস্বার্থ উদ্যোগ ‘দেশের জন্য সোপান’ এর মাধ্যমে তা একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠায় পরিণত হয়েছিল। এই সময়টায় তার পরিচিতির পরিধি কেবল ক্যাম্পাসে নয়, দেশের বিভিন্ন প্রকৌশল কলেজের মেধাবী ছাত্রদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। হৃদয় বিশ্বাস করত, একার পক্ষে দেশের সমস্যা সমাধান করা অসম্ভব; তাই প্রয়োজন ছিল সমমনা দেশপ্রেমিকদের নিয়ে একটি বিশাল বন্ধুত্বের জাল তৈরি করা, যারা ভবিষ্যতে যার যার অবস্থান থেকে দেশকে সেবা করবে।
হৃদয় তার বন্ধু শফিককে নিয়ে এই নেটওয়ার্কিং-এর কাজটি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে করত। সে বিভিন্ন প্রকৌশল ও স্থাপত্য কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের উদ্ভাবনী ধারণাগুলো জানতে চাইত। তার উদ্দেশ্য ছিল না নেতৃত্ব দেওয়া, বরং তাদের মধ্যেকার জ্ঞান ও সম্পদকে সমন্বয় করে দেশের বৃহত্তর কল্যাণে ব্যবহার করা। হৃদয়ের এই ঐক্য ও সংহতির প্রচেষ্টা ছিল তার দেশপ্রেমের একটি নীরব কিন্তু শক্তিশালী প্রকাশ।

এই নেটওয়ার্কিং-এর মাধ্যমেই হৃদয়ের সাথে প্রীতি নামে একজন স্থাপত্য বিভাগের ছাত্রীর পরিচয় হয়। প্রীতি ছিল একজন অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং মেধাবী ছাত্রী, যিনি গ্রামীণ আবাসন নিয়ে গবেষণা করতেন। হৃদয়ের সেই অহংকারহীনতা, কাজের প্রতি দৃঢ়তা এবং নারীর প্রতি তার আকর্ষণহীনতা প্রীতিকে মুগ্ধ করে। প্রীতি তার চারিত্রিক গুণাবলীতে এতটাই আকৃষ্ট হয় যে, সে হৃদয়ের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার স্বপ্ন বুনতে শুরু করে।
প্রীতি হৃদয়কে তার একটি গবেষণা কাজে সহায়তা করার প্রস্তাব দেয়। হৃদয় সেই প্রস্তাবকে সম্পূর্ণ পেশাগত দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণ করে, যা প্রীতির ব্যক্তিগত আবেগ থেকে বহু দূরে ছিল। হৃদয় নিলুফা বা জুঁইয়ের মতোই প্রীতির আবেগও উপলব্ধি করতে পারত না, কারণ তার পুরো মনোযোগ ছিল সমস্যা সমাধানের প্রতি। এই মেয়েদের নীরব আকর্ষণ হৃদয়ের কাছে ছিল কেবল তার কাজের প্রতি সম্মান—যা তাকে আরও বেশি নম্র ও বিনয়ী হতে সাহায্য করত।
এই সময়ে হৃদয়ের প্রকৌশলী জীবনের ভিত্তি মজবুত হতে শুরু করে। সে ক্লাসের পড়া শেষ করার পরপরই তার স্বাধীন গবেষণা শুরু করে দিত। বিশেষ করে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে স্বল্প খরচে টেকসই সমাধান নিয়ে তার গবেষণা ছিল ব্যতিক্রমী। তার এই সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি তাকে অন্যান্য ছাত্রদের থেকে আলাদা করে তুলেছিল।
হৃদয় এই গবেষণার জন্য কোনো সরকারি বা বেসরকারি ফান্ডের জন্য আবেদন করত না। তার বিশ্বাস ছিল, মহান আল্লাহ্র একজন প্রকৃত গোলামের কর্তব্য হলো শুধু কাজ করে যাওয়া; ফল বা প্রতিদান আল্লাহই দেবেন। তার এই নিঃস্বার্থ উদ্যোগের কারণে তাকে অনেকে ‘পাগল’ বলত, কিন্তু হৃদয় তার ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে কাজ চালিয়ে যেত। এই ধৈর্য তাকে তার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হতে দেয়নি।
ধীরে ধীরে, হৃদয়ের এই জ্ঞান এবং উদ্ভাবনী সমাধানগুলো দেশের বিভিন্ন এনজিও এবং ছোট ছোট উন্নয়ন সংস্থার নজরে আসে। তারা হৃদয়কে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের প্রকল্পে পরামর্শক (Consultant) হিসেবে কাজ করার প্রস্তাব দিতে শুরু করে। যদিও সে তখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তার জ্ঞান ও প্রজ্ঞাই তাকে এই সম্মান এনে দেয়। এইভাবেই হৃদয়ের জীবনে একজন ‘স্বাধীন গবেষণা প্রকৌশলী ও পরামর্শক’ হওয়ার প্রাথমিক যাত্রা শুরু হয়।
পরামর্শক হিসেবে তার কাজ ছিল অত্যন্ত সীমিত, তবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সে তার কাজের বিনিময়ে কখনোই কোনো বড় অর্থ চাইত না; তার পারিশ্রমিক ছিল কেবল কাজের উপকরণ এবং প্রকল্পের সফলতা। তার এই আত্মত্যাগ এবং সততা তাকে একজন বিশ্বাসযোগ্য পরামর্শক হিসেবে পরিচিতি এনে দেয়। তার এই প্রাথমিক পরিচিতি দ্রুতই ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
হৃদয় এই সময় বুঝতে পারে যে, দেশের সেবা করার জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতা যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন প্রযুক্তিগত জ্ঞান এবং নৈতিক মেরুদণ্ড। সে তার প্রকৌশল পড়াকে শুধু একটি ডিগ্রি হিসেবে না দেখে, দেখে দেশের পুনর্গঠনের চাবিকাঠি হিসেবে। তার এই জ্ঞান তখন তার দেশপ্রেমের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে ওঠে।
এভাবেই হৃদয়ের নীরব উপাখ্যান চলতে থাকে। সে তার পড়ালেখা, গবেষণা এবং পরামর্শক হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে নিজেকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করে। নারীর প্রেমময় হাতছানি থেকে নিজেকে দূরে রেখে, সে বন্ধুত্বের মাধ্যমে দেশের প্রতিটি কোণে তার আলো ছড়ানোর জন্য একটি শক্তিশালী ‘সোপান’ তৈরি করে। এই পর্বটি ছিল তার ৪০ বছর বয়সে দেশের নেতৃত্ব দেওয়ার স্বপ্নের দিকে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।


















