সোপান: এক দেশপ্রেমিকের নীরব উপাখ্যান : পর্ব ০৯
- আপডেট সময় : ০৮:৫৫:৪৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৫
- / 39
(পর্ব ০৯ : উত্তরাঞ্চলে পদচারণা ও উদ্ভাবনের পরীক্ষা)
হৃদয়ের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন তখন মধ্যগগনে। তার স্বাধীন গবেষণা প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্ন তাকে শুধু ক্লাসরুমের চার দেয়ালের মধ্যে আটকে রাখেনি। তার সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি ছিল দেশের উত্তরাঞ্চলের গ্রামীণ জনপদের দিকে, যেখানে বন্যা, নদীভাঙন ও দুর্বল অবকাঠামো ছিল নিত্যনৈমিত্তিক সমস্যা। হৃদয় তার বন্ধু শফিককে সঙ্গে নিয়ে এবং স্থানীয় প্রকৌশল বন্ধুদের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে উত্তরাঞ্চলের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে তার প্রথম বড় களকর্ম (fieldwork) শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়।
এই களকর্মের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সেখানকার মানুষের জন্য জল ব্যবস্থাপনার একটি স্বল্প খরচের ও টেকসই মডেল তৈরি করা। হৃদয় সেখানে কোনো অর্থ বা পদমর্যাদার জন্য যায়নি, গিয়েছিল কেবল মহান আল্লাহ্র একজন প্রকৃত গোলাম হিসেবে মানুষের সেবার উদ্দেশ্যে। তার অহংকারহীনতা এবং আত্মত্যাগ স্থানীয় মানুষদের মুগ্ধ করে। তারা বুঝতে পারে, এই তরুণ অন্যান্যদের মতো নয়, সে সত্যিই তাদের কল্যাণে নিবেদিত।
উত্তরাঞ্চলে তাদের এই কাজের খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এই সময় তামান্না নামের একজন স্থানীয় শিক্ষিকা হৃদয়ের কাজের প্রতি আকৃষ্ট হন। তামান্না গ্রামকে ভালোবাসতেন এবং হৃদয়ের মতো একজন উচ্চশিক্ষিত তরুণের গ্রামের সমস্যা সমাধানে এমন নিঃস্বার্থ উদ্যোগ দেখে তিনি মুগ্ধ হন। তামান্নার চোখে হৃদয় ছিল এক আদর্শ পুরুষ—যাকে ভালোবাসার স্বপ্ন দেখা যায়। তার মনেও হৃদয়ের প্রতি একটি গভীর অনুরাগ জন্ম নেয়।

তামান্না হৃদয়কে তাদের কাজে সাহায্য করতে চান। হৃদয় তার সহায়তা গ্রহণ করে, তবে বরাবরের মতোই তার মনোযোগ সম্পূর্ণ পেশাগত এবং মানবিকতার স্তরে রাখে। তামান্নার ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা, তার চোখের নীরব ভালোবাসা বা তার সৌন্দর্যের প্রতি হৃদয়ের কোনো খেয়ালই ছিল না। তার কাছে তামান্না ছিলেন কেবল একজন সহায়ক সহকর্মী, যিনি দেশের কল্যাণে এগিয়ে এসেছেন। হৃদয় নারীর আকর্ষণ থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ দূরে রাখার যে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তা এখানেও প্রতিফলিত হয়।
হৃদয় তার প্রকৌশল জ্ঞান এবং প্রজ্ঞাকে কাজে লাগিয়ে একটি উদ্ভাবনী জল সংরক্ষণ পদ্ধতি তৈরি করে, যা স্থানীয় উপকরণ দিয়েই নির্মাণ করা সম্ভব। তার এই উদ্ভাবন ছিল অত্যন্ত বাস্তবসম্মত এবং পরিবেশবান্ধব। এই সফলতায় হৃদয় একটুও আত্মশ্লাঘা বোধ করে না, বরং আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানায়—যে আল্লাহ্ তাঁকে এই জ্ঞান ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছেন। তার এই নম্রতা তার চারিত্রিক গুণাবলীর প্রধান ভিত্তি হয়ে ওঠে।
হৃদয়ের এই উদ্ভাবন স্থানীয় কৃষি ও জীবনযাত্রায় দ্রুত ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে শুরু করে। তার এই কাজের খ্যাতি স্থানীয় প্রশাসন এবং ছোট ছোট উন্নয়ন সংস্থাগুলোর নজরে আসে। তারা হৃদয়কে আরও বেশ কয়েকটি প্রকল্পে পরামর্শক হিসেবে কাজ করার প্রস্তাব দেয়। একজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র হয়েও সে দেশের উত্তরাঞ্চলে একজন বিশ্বাসযোগ্য ‘স্বাধীন গবেষণা প্রকৌশলী ও পরামর্শক’ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করে।
প্রীতির মতো তার অন্যান্য বন্ধুরা যারা বিভিন্ন অঞ্চলে কাজ করত, তারা হৃদয়ের এই সফলতাকে নিজেদের সফলতা হিসেবে দেখত। তাদের মধ্যে কোনো ঈর্ষা ছিল না, ছিল কেবল ঐক্য ও সংহতির বন্ধন। হৃদয়ের চরিত্রই এমন এক চুম্বক ক্ষেত্র তৈরি করেছিল যে, সবাই তাকে সমর্থন করতে বাধ্য হতো। তার এই নেতৃত্ব ছিল নীরবে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যমে।
হৃদয় তার প্রতিটি সফলতাকে নিজের দেশপ্রেমের এক-একটি সোপান হিসেবে দেখত। সে বিশ্বাস করত, ছোট ছোট সমস্যার সমাধানই একদিন বৃহত্তর জাতীয় সমস্যা সমাধানে সাহায্য করবে। তার এই সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি তাকে কখনও তাড়াহুড়ো করতে দিত না, বরং ধৈর্য ও নিষ্ঠার সাথে এগিয়ে যেতে উৎসাহিত করত।
এভাবেই হৃদয়ের নীরব উপাখ্যান চলতে থাকে। উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তার পদচারণা তাকে দেশের মাটির সঙ্গে আরও গভীরভাবে যুক্ত করে। নারীর নীরব প্রেম, খ্যাতি ও অর্থের প্রলোভন থেকে নিজেকে দূরে রেখে সে দেশের উন্নয়নে মনোনিবেশ করে। তার প্রকৌশলী জীবনের এই কঠিন পরীক্ষা তাকে তার চূড়ান্ত লক্ষ্য, অর্থাৎ ৪০ বছর বয়সে দেশের নেতৃত্ব দেওয়ার স্বপ্নের দিকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়।


















