সোপান: এক দেশপ্রেমিকের নীরব উপাখ্যান : পর্ব ১০
- আপডেট সময় : ০৮:২৯:০৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ২২ নভেম্বর ২০২৫
- / 28
(পর্ব ১০ : দুর্নীতির মুখোমুখি এবং জীবনের ঝুঁকি)
উত্তরাঞ্চলে হৃদয়ের সফল উদ্ভাবনগুলি তাকে ‘স্বাধীন গবেষণা প্রকৌশলী ও পরামর্শক’ হিসেবে দ্রুত পরিচিতি এনে দেয়। তার এই খ্যাতি কেবল সাধারণ মানুষের কাছে নয়, সেই সব ক্ষমতাধর গোষ্ঠীর কাছেও পৌঁছায়, যারা দেশের দুর্নীতিগ্রস্ত অবকাঠামো প্রকল্পের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করত। হৃদয় তখন প্রায় ১৯ বা ২০ বছরের তরুণ, কিন্তু তার জ্ঞান ও সততা ছিল অনেক প্রবীণের চেয়েও বেশি দৃঢ়। সে বুঝতে পারে, তার এই সৎ পথে চলার কারণে দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক নীরব সংঘাত শুরু হচ্ছে।
হৃদয়ের ‘দেশের জন্য সোপান’ সংগঠনটি ছোট হলেও তাদের কাজের গুণগত মান ছিল প্রশ্নাতীত। তারা স্থানীয় উপকরণ এবং সহজলভ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে যে টেকসই সমাধান দিত, তা বড় ঠিকাদারদের ব্যয়বহুল ও নিম্নমানের কাজকে চ্যালেঞ্জ করত। হৃদয়ের নৈতিকতা ও সততা ছিল এমন একটি আয়না, যেখানে দুর্নীতিগ্রস্তরা নিজেদের কুৎসিত চেহারা দেখতে পেত। ফলে তারা হৃদয়কে তাদের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে চিহ্নিত করে।

হৃদয় তার বন্ধু শফিককে নিয়ে দেশের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে একটি বড় সেচ প্রকল্পের ত্রুটি নিয়ে কাজ করতে শুরু করে। প্রকল্পটি ছিল বিশাল অঙ্কের অর্থের, কিন্তু নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রীর কারণে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। হৃদয়ের সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি বুঝতে পারে, এই ত্রুটি শুধু প্রকৌশলগত নয়, এর পেছনে রয়েছে গভীর দুর্নীতি। হৃদয়ের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা তাকে এই সমস্যার মূল শিকড় পর্যন্ত পৌঁছাতে সাহায্য করে।
এই সময়ে ফারিহা নামের একজন দুর্নীতিবিরোধী সাংবাদিক হৃদয়ের কাজের প্রতি আকৃষ্ট হন। ফারিহা সাহসী ছিলেন এবং দেশের দুর্নীতির বিরুদ্ধে লেখালেখি করতেন। তিনি হৃদয়ের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ এবং ঝুঁকি নেওয়ার মানসিকতা দেখে মুগ্ধ হন। ফারিহার মনে হয়, হৃদয়ই সেই আদর্শ মানুষ—যাকে নিয়ে দেশের স্বপ্ন দেখা যায়। তার সাংবাদিক মন ছাপিয়ে হৃদয়ের প্রতি এক ব্যক্তিগত আকর্ষণ সৃষ্টি হয়, যা সে প্রকাশ করতে পারত না।
ফারিহা হৃদয়কে এই সেচ প্রকল্পের দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ করার প্রস্তাব দেয়। হৃদয় অত্যন্ত সতর্কতার সাথে তথ্য সরবরাহ করে, তবে বিনিময়ে কোনো খ্যাতি বা অর্থ গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। সে তার দায়িত্ববোধ থেকে শুধু দেশের কল্যাণের জন্য তথ্য দিত। ফারিহার ব্যক্তিগত অনুভূতি বা তার আকাঙ্ক্ষার প্রতি হৃদয়ের বিন্দুমাত্র মনোযোগ ছিল না; তার কাছে ফারিহা ছিলেন কেবল ন্যায়ের পথে একজন গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী।
হৃদয় যখন সেচ প্রকল্পের ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করে আইনিভাবে প্রমাণ জোগাড় করে, তখন প্রভাবশালী ঠিকাদার চক্র হৃদয়কে থামাতে মরিয়া হয়ে ওঠে। তারা তাকে ভয় দেখায়, তাকে বড় অঙ্কের ঘুষের প্রলোভন দেয় এবং তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনার হুমকিও দেয়। হৃদয়ের জীবনের এটি ছিল প্রথম বড় ঝুঁকি। এই পরিস্থিতিতে তার সাহস ও দৃঢ়তার চরম পরীক্ষা হয়।
হৃদয় কিন্তু এতটুকু বিচলিত হয় না। সে আল্লাহর একজন প্রকৃত গোলাম হিসেবে বিশ্বাস করত, সত্যের পথ কখনো বৃথা যায় না। তার নম্রতা ও অহংকারহীনতা তাকে শান্ত থাকতে সাহায্য করে। সে ঘুষের প্রস্তাব দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে এবং তার নৈতিকতা থেকে এক চুলও সরে আসে না। তার এই অবিচলতা তার চারিত্রিক গুণাবলীর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে।
হৃদয়ের নিরলস প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ, ফারিহার মাধ্যমে সেই দুর্নীতি ও ত্রুটির খবর জাতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এতে দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। সরকার তদন্ত কমিটি গঠন করতে বাধ্য হয় এবং সেই প্রভাবশালী ঠিকাদার চক্র ধরা পড়ে। হৃদয়ের এই বিজয় ছিল দেশের জন্য তার একটি বিরাট আত্মত্যাগ। তার পরিচিতির পরিধি এখন জাতীয়ভাবে বিস্তৃত হতে শুরু করে।
কিন্তু এই বিজয়ের পরই হৃদয় বুঝতে পারে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জীবন ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। ঠিকাদার চক্রের লোকেরা হৃদয়কে নানাভাবে ক্ষতি করার চেষ্টা করতে থাকে। হৃদয় তার জীবনের এই প্রথম বড় ঝুঁকিকে ভয় না পেয়ে বরং আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পণ করে। তার ইতিবাচক মানসিকতা তাকে শিখিয়েছিল, মহৎ লক্ষ্য অর্জনের জন্য যেকোনো ঝুঁকি মেনে নিতে হবে।
এভাবেই হৃদয়ের নীরব উপাখ্যান চলতে থাকে। সে প্রকৌশল জ্ঞান, নৈতিকতা এবং আল্লাহর উপর ভরসা রেখে দুর্নীতির বিরুদ্ধে একাই লড়াই চালিয়ে যায়। নারীর প্রেমময় আকাঙ্ক্ষা বা ব্যক্তিগত জীবনের নিরাপত্তা—কোনো কিছুই তাকে তার দেশের কল্যাণের পথ থেকে সরাতে পারেনি। তার এই কঠিন পথচলা ৪০ বছর বয়সে তার স্বপ্নের রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়।


















